‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি’ দাবি করে আওয়ামী লীগ। তবে এবার সেই আওয়ামী লীগই বিজয় দিবসে মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের স্মরণ করতে যায়নি স্মৃতিসৌধে। মৌলভীবাজারে কোনো স্তরের নেতাকর্মীদের দেখা যায়নি এবারের বিজয় দিবসে পুষ্পস্তবক অর্পন করতে। এমনকি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচীও দেয়নি দলটি। মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে আওয়ামী লীগ নেতাদের না যাওয়া দলটির ‘রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের বহিঃপ্রকাশ’ বলছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা।
সরেজমিনে মৌলভীবাজার শহর ও জেলার ৭টি উপজেলায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৌলভীবাজার জেলা শহরের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে সকাল ৮টায় শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পন করেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা পরিষদ, বিএনপি ও অঙ্গসংগঠন, সিপিবি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, শিল্পকলা একাডেমী, বিভিন্ন সরকারী দপ্তর, রাজনৈতিক দল, মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবসহ জেলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে উদযাপন করা হয় বিজয় দিবস। তবে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেখা মিলেনি আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মীর। দলটির পক্ষ থেকে কেউ স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে যাননি। শুধু মৌলভীবাজার নয়। জেলার ৭টি উপজেলার কোথাও শ্রদ্ধা জানাতে দেখা মিলে নি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের।
এ ব্যাপারে জানতে মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নেছার আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক মিছবাহুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
বরাবরই নিজেদের ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি’ দাবি করা আওয়ামী লীগ মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের শ্রদ্ধা নিবেদন না করাকে তাদের ‘রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব’ বলছেন অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেবল নিজেদের অর্জন দাবি করে পুরো জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু ১৬ বছর পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে দেশের মানুষ।
মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক মেয়র অ্যাডভোকেট ফয়জুল করিম ময়ুন বলেন, শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে স্মৃতিসৌধে আওয়ামী লীগের না যাওয়াটা তাদের ‘রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব’ প্রকাশ করে। মানুষকে বিভক্ত করতে তারা নিজেদের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মনে করতো। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে প্রশাসনকে ব্যবহার করে আমাদের দলীয় কর্মসূচীতে বহুবার বাধা দিয়েছে। জাতীয় দিবসগুলোতেও যাতে বিএনপির নেতাকর্মীরা অংশ নিতে না পারে সেজন্য নানা ধরনের হয়রানি করেছে। গত ১৬ বছর বাধা উপেক্ষা করেও আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের শহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছি। সকল জাতীয় দিবসে অংশগ্রহণ করেছি।
জেলা জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইয়ামির আলী বলেন, যে দলটি নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর হেলমেট বাহিনী দিয়ে হামলা করে, যাদের নির্দেশে প্রতিবাদ মিছিলে গুলি চালিয়ে শিশু-কিশোর তরুণ তাজা হাজারো প্রাণকে হত্যা করা হয়, মৃত লাশকে আগুনে পুড়ানো হয় তারা কখনোই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হতে পারে না। স্বাধীনতা তো দেশ ও মানুষের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ সারাদেশকে একটি জেলখানায় পরিণত করেছিল। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করে রেখেছিল। তাদের নিষ্ঠুরতা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে হার মানিয়েছে। তারা আবার মানুষের সামনে এসে দাঁড়ালে তা জাতির জন্য হবে কষ্টদায়ক। শহীদ আবু সাঈদ, শহীদ মুগ্ধ এবং নিহত ও আহতদের স্বজনদের নিকট জাতির কোন জবাব থাকবে না।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) জেলা সভাপতি খন্দকার লুৎফুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ গত ১৬ বছর মুক্তিযুদ্ধকে দলীয়করণ করতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙ্গিয়ে দেশে লুটপাট, কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা, দুঃশাসন ও অপরাজনীতি করেছে। দীর্ঘদিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে জনগণ তাদেরকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে। এখন শ্বাস ফেলার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। জনগণের কাছে তাই এখন আওয়ামী লীগ ঘৃণিত একটি দল।
চলতি বছরের ৪ আগস্ট মৌলভীবাজার শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মীর নামে মামলা করেন আহত ও ভুক্তভোগীরা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে এর প্রভাব পরে দলটির উপর। সেই থেকেই পালিয়ে রয়েছেন দলটির মৌলভীবাজারের জেলা-উপজেলা থেকে শুরু করে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। ‘নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ’, যুবলীগ, সেচ্ছাসেবক লীগসহ সকল অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও গা ঢাকা দিয়েছেন।