গ্রিল ওয়ার্কশপের কর্মচারী মো. মমিনুল ইসলাম ওরফে মামুন ইসলাম (৩০) নিজেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় দিতেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে।
এছাড়া কখনো নিজেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী উপ-সচিব, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কখনো ব্যাংক কর্মকর্তা আবার কখনো ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দিয়ে সম্পর্ক করতেন বিভিন্ন বয়সী নারীর সঙ্গে। পরে এসব নারীদের বিয়ে করে কিছু দিন একসঙ্গে থাকতেন। সুযোগ বুঝে গোপনে ধারণ করতেন একান্ত মুহূর্তের ভিডিও। এরপর সেসব ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আদায় করতেন অর্থ।
অন্তত ১০টি বিয়ে করা মামুন বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে বদলি বাণিজ্য বা মন্ত্রীর বিদেশ সফরে সঙ্গী করার প্রলোভনে প্রতারণার মাধ্যমে অনেকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। পল্টন থানায় এক ভুক্তভোগী নারীর পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় মামুনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বুধবার (৩১ আগস্ট) দিনাজপুরের খানসামা থানাধীন আমতলী বাজার থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার মোবাইলে ৫০ এর অধিক নারীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথোপকথন ও অসংখ্য আপত্তিকর ভিডিও পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) এস এম আশরাফুল আলম।
এস এম আশরাফুল আলম বলেন, প্রতারক মামুন ইসলাম পেশায় গ্রিল ওয়ার্কশপের কর্মচারী। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে একজন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী উপ-সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যাংক কর্মকর্তা আবার কখনো ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দিতেন।
নিজেকে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে ১০টি বিয়ে করেছেন তিনি।
সিআইডি জানায়, মামুন প্রতারণার সুবিধার্থে নিজের আসল পরিচয় গোপন করে তথ্য অবিকৃত রেখে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তার শরীরের অবয়বের সঙ্গে মিলে যায় এমন শারীরিক গঠনের মুখে মাস্ক পরিহিত কিংবা মুখাবয়ব স্পষ্ট বোঝা যায় না এমন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের ছবি নিজের ছবি হিসেবে ব্যবহার করতেন তিনি।
মামুনের টার্গেট বিয়ের পর ব্ল্যাকমেলিং
এস এম আশরাফুল আলম বলেন, মামুনের বেশি আগ্রহ বিভিন্ন বয়সী নারীর প্রতি। সরকারি কর্মকর্তা সেজে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া ছবি ব্যবহার করে মেয়েদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক স্থাপন করতেন। সম্পর্কের এক পর্যায়ে তিনি ভুক্তভোগী নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন। যদি কেউ তার বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া না দিতেন, তাহলে মামুন আত্মহত্যা করবে বলে ব্ল্যাকমেল করে রাজি করাতেন। পরে বিয়ের ফাঁদে ফেলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।
যেভাবে ধরা পড়লেন প্রতারক মামুন
সিআইডি জানায়, এক নারীর সঙ্গে প্রতারক মামুনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় মামুন নিজেকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দেন। তাদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হলেও মামুন কখনো ভিকটিমের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতেন না।
বিভিন্ন সরকারি কাজে খুবই ব্যস্ত আছে অথবা তার ছুটি হচ্ছে না এ রকম অজুহাতে সরাসরি বিয়ে করতে আসতে পারছে না বলে জানান। একপর্যায়ে মামুন ভুক্তভোগীর নামে কাজী অফিসের সিলমোহরযুক্ত ভুয়া নিকাহনামা প্রস্তুত করে নির্ধারিত ঠিকানায় কুরিয়ার করে পাঠান। ওই নারীকে কাবিননামায় স্বাক্ষর করে আবার মামুনের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে বলে।
ভুক্তভোগী নারী সরল বিশ্বাসে মামুনের কথামতো কাজ করার কিছুদিন পর মামুন তার বাসায় যান। এরপর ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক বিয়ে করে কিছুদিন একসঙ্গে বসবাস করেন। ভুয়া বিয়ের পর প্রতারক মামুন নারীর আপত্তিকর ও অশালীন অবস্থায় ভিডিও কলে আসতে বলতেন। আপত্তিকর অবস্থার ভিডিও কলে কথোপকথনের সময় ভিডিও কলের স্ক্রিন রেকর্ড করে সেই ভিডিওগুলো নিজ মোবাইলে সংরক্ষণ করে রাখেন মামুন।
পরে ভিডিওগুলো অনলাইনে ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে অর্থ দাবি করতে থাকে। এভাবে সে ভিকটিমদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে।
একপর্যায়ে ভিকটিম নারী প্রতারক মামুনের প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হয়ে ডিএমপির পল্টন থানায় পর্নোগ্রাফি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তের ধারাবাহিকতায় মামুনকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসএসপি এস এম আশরাফুল আলম বলেন, গ্রেপ্তারের সময় মামুনের কাছ থেকে ৫টি নকল নিকাহনামা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বদলির ভুয়া অফিস আদেশের কপি ও প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ২টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়।
মামুনের আসল নাম মো. মমিনুল ইসলাম। তিনি উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কমপক্ষে ১০টি বিয়ে করেছেন। তার মোবাইলে ৫০ এর বেশি নারীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথোপকথন ও অসংখ্য আপত্তিকর ভিডিও পাওয়া গেছে।