ঢাকা ওয়াসার সাতটি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। এ ঋণের একটি অংশ ওয়াসা ইতিমধ্যে নিয়েছে। বাকিটা অনুমোদিত, যা প্রকল্প বাস্তবায়নের পর্যায়ে নেওয়া হবে। এক যুগ আগেও ঢাকা ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল শূন্যের কোঠায়।
সমস্যা হলো ঋণ নিয়ে ঢাকা ওয়াসা যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তার পুরো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার কয়েকটির পুরো সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে।
যেমন পদ্মা নদীর পানি পরিশোধন করে ঢাকায় সরবরাহের জন্য ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে ঢাকা ওয়াসা। এ জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
তিন বছর আগে পরিশোধনাগারটি চালু হয়। এখন উৎপাদন সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ অব্যবহৃত। বাকি পরিশোধনক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না পদ্মা-যশলদিয়া শোধনাগার থেকে রাজধানীতে পানি সরবরাহের পাইপলাইন না থাকায়। ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এখন পাইপলাইন বসাতে ৬২২ কোটি টাকা ব্যয়ে আরেকটি প্রকল্প নিতে চায়, যার পুরোটাই হবে বৈদেশিক ঋণে।
বিপুল ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। এ কারণে বছর বছর পানির দাম বাড়াচ্ছে তারা, যা চাপে ফেলছে নগরবাসীকে।
ঢাকা ওয়াসা গত ৯ ফেব্রুয়ারি পানির দাম আরেক দফা বাড়ানোর বিষয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে এক সভার আয়োজন করে। এতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান বলেন, ‘ওয়াসা বিদেশি ঋণে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। এসব ঋণের গ্যারান্টার (জামানতকারী) বাংলাদেশ সরকার। এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধে ওয়াসাকে এখন বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।’
ঢাকা ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি হওয়ার কারণে।
পদ্মা-যশলদিয়া ছাড়া ঢাকা ওয়াসার বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পগুলো হলো দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার (বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা), সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার (পর্ব-৩) প্রকল্প (৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা), ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প (২ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা), ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প (৫ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা), ঢাকা স্যানিটেশন ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্প (২ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা) এবং সাভারের ভাকুর্তায় অবস্থিত গভীর নলকূপ প্রকল্প (৩৬২ কোটি টাকা)। ঢাকা ওয়াসার সাতটি প্রকল্পের মধ্যে তিনটির কাজ শেষ। বাকি চারটি প্রকল্পের কাজ বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার প্রকল্প বাস্তবায়নের মাসিক অগ্রগতি প্রতিবেদন (জুন) বিশ্লেষণ করে বিদেশি ঋণের পরিমাণের এ হিসাব পাওয়া যায়। তবে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হওয়ায় ওয়াসার ঋণের পরিমাণ (টাকার অঙ্কে) আরও বাড়বে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
ঢাকা ওয়াসা ঋণের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে অদক্ষতাও দেখিয়েছে। বারবার প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বেড়েছে। যেসব প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে, তার একটি ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প। এর আওতায় মেঘনা নদীর পানি পরিশোধন করে রাজধানীতে সরবরাহ করার কথা। ৯ বছর আগে সোয়া পাঁচ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পের মেয়াদ তিন দফা বাড়ানো হয়েছে। ব্যয় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে আট হাজার কোটি টাকা। যদিও প্রকল্পের অগ্রগতি এখনো ৫৫ শতাংশ। এ বাড়তি ব্যয়ের অর্থ পানির দামের সঙ্গে নগরবাসীকে দিতে হবে।
ঢাকা ওয়াসার নেওয়া বৈদেশিক ঋণের সুদের হার কত, মেয়াদ কত বছর—এসব বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সংস্থাটির জনসংযোগ বিভাগে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হয় ১ আগস্ট। সংস্থাটির উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক এ বিষয়ে ওয়াসার পরিচালক (উন্নয়ন) আবুল কাশেমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। আবুল কাশেমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি। প্রশ্নের জবাবও পাঠায়নি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
তবে সূত্র জানিয়েছে, গত অর্থবছরে (২০২১-২২) ঢাকা ওয়াসার ঋণের কিস্তির পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকা। আগামী কয়েক বছরে তা আরও বাড়বে। উল্লেখ্য, ওয়াসা পানি বিক্রি করে বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মতো আয় করে। সরকারের ভর্তুকি বাদ দিয়ে এটি একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঋণ পরিশোধের চাপের কারণেই ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বাড়াতে মরিয়া। এর আগে তারা গত ১৩ বছরে ১৫ বার পানির দাম বাড়িয়েছে।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, পরিকল্পনাগত ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাস্তবসম্মত ও টেকসই না হওয়া সত্ত্বেও বিপুল অঙ্কের ঋণে একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যার ফলে পানির দাম বাড়াতে হয়েছে। অদক্ষতার কারণে প্রকল্পগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত সুফলও পাওয়া যায়নি। এ ধরনের প্রকল্প দেশের সার্বিক অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলেছে, যা এখন দৃশ্যমান হচ্ছে।